এমরান মাহমুদ প্রত্যয়,নওগাঁ সংবাদদাতা:
হেমন্তের সকালে ঘাসের ডগায় জ্বলজ্বলে শিশির বিন্দু। আবছা কুয়াশা ভেদ করে পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। খেজুর পাতার মাঝে সূর্যের উঁকি যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে গাছির। তবুও আপন মনে গাছ পরিচর্যায় করে যাচ্ছেন তিনি। চারিদিকে পড়েছে শীতের আগমনী বার্তা।শীতের আগমনী বার্তায় শুরু হয়েছে রস আহরণ। তাই নওগাঁর আত্রাইয়ের গাছিদেরও বেড়েছে ব্যস্ততা।
আত্রাইয়ে শীতের আগমনে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গাছিরা। উপজেলার বিভিন্ন রাস্তায়,বাড়ির উঠানে, জমির আইলে ও রেললাইনের দুইপাশ দিয়ে হাজার হাজার খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে গাছিরা তৎপর হয়ে উঠেছে। বিকেল হবার সাথে সাথে চলছে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য কলস লাগানোর ধুম। আবার ভোর থেকেই এ কলসগুলো নামিয়ে রস জ্বাল দিয়ে লালি ও গুঁড় তৈরি করা হয়।
জানা যায়,আত্রাই নওগাঁ সড়কের পাশে,আত্রাই রেলওয়ে স্টেশন থেকে উত্তর দিকে রেললাইনের দুই পাশে এবং এলাকার বিভিন্ন স্থানে শত শত খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে এসব খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে লালি ও গুৎড় তৈরি করা হয়। এসব লালি ও গুঁড় অত্যন্ত সুস্বাদু। বিশেষ করে শীতের পিঠাপুলি খেজুরের রস বা গুঁড় ছাড়া কল্পনাই করা যায় না।
এ এলাকার কৃষক ও লোকজন খেজুর রস সংগ্রহে তেমন অভিজ্ঞ না হওয়ায় প্রতি বছরই দক্ষিণ এলাকা রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট ও নাটোরের লালপুর এলাকা থেকে গাছি এসে এ অঞ্চলের খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য বারের ন্যায় এবার ওই অঞ্চল থেকে অনেক গাছি এসেছেন এলাকায়। আত্রাই রেললাইন এলাকার খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার রহিম উদ্দিন (৫০),শামসুর রহমান (৪০),আলাউদ্দিন(৬৫) ও নয়ন (২৫)।
শীত মৌসুমের আগে আগে নভেম্বর মাস থেকে মার্চ এপ্রিল ৫ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যায়। আর এ রস জাল করে লালি বা গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রির অর্থ দিয়ে প্রায় সারা বছর পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন গাছিরা।
গাছি আলাউদ্দিন জানান, তাদের এলাকার অনেক গাছি শীত মৌসুমে এ এলাকায় খেজুর রস সংগ্রহের জন্য এসে থাকেন। এবারেও অনেকেই এসেছেন। তারা বিভিন্ন গ্রামের এবং সড়কের পাশের খেজুর গাছ চুক্তিভিত্তিতে নিয়েছেন মালিকের কাছ থেকে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ খেজুর গাছ থেকে ৭-৮ মণ রস নামে। এ রস জাল করলে প্রায় দেড়/দুই মণ গুড় হয়। গুড়গুলো নওগাঁসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে বিক্রি করে যে অর্থ আসে এতে তারা খুব খুশি।
আহসানগঞ্জ ইউনিয়নের সিংসাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো.আলহাজ্ব ওমর আলী বলেন,শীতের আগমনে হারিয়ে যায় সেই শৈশবে।শীতের সকালে খেজুর রস আর মুড়ি ছাড়া যেন সকালই জমতো না। আর’আমরা ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের এলাকার গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহ করে বাজারে রস বিক্রি করতো। এখন এলাকার গাছিরা আর খেজুর রস সংগ্রহ করে না। গাছগুলো বছরের পর বছর পরিত্যক্ত থাকতো। গত কয়েক বছর ধরে অন্য এলাকার গাছিদের কাছে গাছ চুক্তি দিচ্ছি। এতে করে গাছগুলোরও পরিচর্যা হচ্ছে আবার কিছু অর্থও আমরা পাচ্ছি।’
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ প্রসেনজিৎ তালুকদার বলেন, খেজুর গাছ একটি লাভজনক গাছ।
এ গাছের পরিচর্যা করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি শিল্প আর দক্ষতায় ভরা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌশল, রয়েছে ধৈর্য ও অপেক্ষার পালা। এ জন্য মৌসুম আসার সাথে সাথে দক্ষ গাছিদের কদর বাড়ে।
এদিকে উপজেলার সচেতন মহল মনে করেন, খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। এই ঐতিহ্যকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।