জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৩৪টির মধ্যে ১০টিতে হেরে যাওয়ার জন্য কয়েকটি কারণ দায়ী বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতারা। তারা মনে করছেন, বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই অনেকটা একতরফা এ নির্বাচনে জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
আবার কোথাও কোথাও দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্থানীয় এমপি ও দলের একাংশ কাজ করেছেন। রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের নির্বাচনি আসন পঞ্চগড়ের বোদা ও দেবীগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরেছেন। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের আসনেও দলীয় প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। এছাড়া এ নির্বাচনে টাকায় ভোট কেনার প্রবণতাও ফলাফলে প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন তারা। জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওই নেতারা আরও জানান, কয়েক জেলায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের আত্মবিশ্বাস বেশি ছিল। তারা নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করবেন এমন লক্ষ্যও ছিল। জেলা পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় তাদের সেই আশা গুড়েবালি। জেলা পরিষদ নির্বাচন সিসি ক্যামেরায় সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশন।
এর আগে একই প্রক্রিয়ায় গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনে অনিয়মের কারণে পুরো নির্বাচনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ছিল সুষ্ঠু, অবাধ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন করা। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে নানা ধরনের ইকুয়েশন থাকে। এখানেও তা থাকতে পারে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা নির্দলীয় প্রতীকে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়নি, সমর্থন দিয়েছে। প্রতীক না থাকায় সেখানে অনেকেই প্রার্র্থী হয়েছেন। এ কারণেও ফল এরকম হতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে এবারও বিদ্রোহী প্রার্থী নুরুল হুদা মুকুট চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নুরুল হুদা মুুকুট গত নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। এবার আওয়ামী লীগের সমর্থন পান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবীর ইমনের ভাই মো. খায়রুল কবীর রুমেন। জেলা জজ আদালতের পিপি পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এ প্রার্থী পরাজয়ের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ-সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, তাদের জন্য আমি হেরে গেছি। তাদের উপজেলাগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জিততে দেওয়া হয়নি। দলীয় কোন্দলের কারণে আমি হেরে গেছি। তবে উলটো অভিযোগ করেছেন নির্বাচিত চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কোনো মন্ত্রী-এমপি আমাকে জেতায়নি। আমার জনপ্রিয়তায় বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছি। বিগত নির্বাচনেও আমি বিপুল ভোট পেয়ে জয়ী হই। এবার দল আমার সেই জনপ্রিয়তা বিবেচনায় নেয়নি। অজনপ্রিয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী হেরেছেন।
কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাদের তিনজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শাহীনুল হক মার্শাল জয়ী হয়েছেন। বিপুল অর্থবিত্তের মালিক তিনি। স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রার্থী ও তার সমর্থকেরা ভোটারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন। অনেক ভোটারকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া প্রার্থী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ভোটারদের দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দিলে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রশাসকও ছিলেন। ওই সময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। তার পরাজয়ের জন্য এসব কারণও ছিল বলে মনে করে জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, পরাজয়ের কারণ নিয়ে আমরা এখনই কোনো মন্তব্য করছি না। সব উপজেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ ও সাধারণ সভা শেষে পরাজয়ের কারণ গণমাধ্যমে জানানো হবে। প্রায় একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ নির্বাচনে। এ নির্বাচনে সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রশাসক কনক কান্তি দাস হেরে গেছেন। তার প্রতিন্দ্বন্দ্বী এম হারুন অর রশীদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কনক কান্তি দাস চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় তার সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দূরত্ব রয়েছে। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে একটি অংশের নেতৃত্ব দেন তিনি। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরেক অংশ তার বিরোধিতা করেছে। অপরদিকে এ নির্বাচনে জয়ী হারুন অর রশীদ স্থানীয়ভাবে বড় ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত। গত নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। তখন থেকেই তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে আসছেন।
পঞ্চগড় জেলা প্রতিনিধি এসএ মাহমুদ সেলিম জানান, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবু তোয়াবুর রহমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও খোদ রেলপথমন্ত্রী অ্যাড. মো. নুরুল ইসলাম সুজনের নির্বাচনি এলাকা বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলাতেই হেরে গেছেন। এ ব্যাপারে পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. নাঈমুজ্জামান মুক্তা বলেন, নির্বাচনে দলীয় নেতা কর্মীরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেনি, কাজ করেছে লোক দেখানো। এছাড়াও নির্বাচনে প্রচুর টাকার খেলাও হয়েছে।
এটাও আবু তোয়াবুর রহমানের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া নির্বাচনের একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা গোপনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজও করেছেন। তবে দলের কোনো বিভেদ নেই বলে দাবি করেছেন পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট। তিনি বলেন, দলে কোন বিভেদ বা কোন্দল নেই। আওয়ামী প্রার্থীর বিরোধিতাও কেউ করেনি। নির্বাচনে প্রচুর টাকার খেলা হয়েছে এবং তিনি টাকার কাছেই হেরেছেন।