দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা নেত্রকোনার নিম্নাঞ্চলে শনিবার বন্যা শুরু হয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জও বন্যাকবলিত হতে পারে। দু-একদিনের মধ্যে বন্যা শুরু হতে পারে তিস্তাবিধৌত নীলফামারী ও লালমনিরহাটে। গত কয়েক দিন দেশের ভেতর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং মেঘালয়সহ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে এমনটি ঘটতে পারে। অন্যদিকে ঈদের ছুটিতে গত তিন-চারদিন ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর মানুষ।ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। দীর্ঘসময়েও পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না।
আবহাওয়া, জলবায়ু এবং বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে বর্তমানে বর্ষাকাল চলছে। এই সময়ে বৃষ্টি এবং এ থেকে স্বল্পমেয়াদি বন্যার ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। তবে অল্পসময়ে যেভাবে বন্যাকবলিত করছে জনপদ, সেটাই অস্বাভাবিক। এর নেপথ্যে মূলত একটি কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। আর সেটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে। এ কারণে তাপপ্রবাহ, আর্দ্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছিলেন যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার হবে। চলতি বছরে দফায় দফায় তাপপ্রবাহ, কয়েক দিনের ব্যবধানে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি, মৌসুমের শুরুতেই বন্যা এবং গত কয়েক বছরের বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের সতর্কতা বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম জাতিসংঘের একজন প্যানেলভুক্ত জলবায়ু গবেষক। দিল্লিতে অবস্থানরত এই জলবায়ু ও বন্যা গবেষক রোববার যুগান্তরকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে থাকে। এতে নানা ধরনের দুর্যোগ বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে দৃশ্যমান ৬টি হচ্ছে তাপপ্রবাহ, খরা বা অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস অন্যতম। গবেষণা বলছে, এসব দুর্যোগের যখন যেটা আসবে, তখন সেটা ‘চরম’ (এক্সট্রিম) রূপে থাকবে। তাপপ্রবাহ হলে তা অতীতের রেকর্ড ভাঙবে। অল্পসময়ে বেশি বৃষ্টি হবে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা দেখা যাবে। এসব দুর্যোগের সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণের জন্য জলবায়ু উষ্ণায়নে দায়ী জাতিগুলোর কাছ থেকে অর্থ আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।
অধ্যাপক ইসলামের এই কথার প্রমাণ মিলেছে চলতি বছরই। গত মাসে দিনের পর দিন তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে। জুনের প্রথম ১৫ দিনের ১৪ দিনই ছিল তাপপ্রবাহ। চুয়াডাঙ্গায় ১৪ জুন তাপমাত্রা উঠেছিল ৪১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ওই জেলায় বিগত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আর ১৫ জুন ঢাকায় পারদ উঠেছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রিতে, যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ বা ৮ বছরের মধ্যে রেকর্ড।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, আবহাওয়ার দুটি ব্যবস্থা (সিস্টেম) সক্রিয় হলে পৃথিবীতে ঝড়-বৃষ্টি, শুষ্কতা বা খরা এবং শীতের প্রকোপ ইত্যাদি বেড়ে যায়। এর একটি হচ্ছে ‘এল-নিনো বা লা-নিনো’, আরেকটি হচ্ছে ‘ম্যাডেন জুলিয়ান অসিলেশন’ (এমজেও)। এবারের বছরটি এল-নিনোর। প্রশান্ত মহাসাগরের পানির তাপমাত্রা বেশি থাকলে এল-নিনো আর কমে গেলে লা-নিনা ঘটে। এবারে বছরের শেষের দিকে এল-নিনো সক্রিয় হতে পারে। কিন্তু ইতোমধ্যে এর শর্ত দৃশ্যমান। সাধারণত ২ থেকে ৭ বছর পরপর এ ধরনের অবস্থার পুনরাগমন ঘটে। সর্বশেষ ২০১৮-২০১৯ সালে এল নিনো অবস্থা ছিল। এল-নিনো ঘটলে পৃথিবীতে শুল্কতা, ঝড়-বৃষ্টি বেড়ে যায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) তথ্য অনুযায়ী, এল নিনোর প্রভাবও দৃশ্যমান বাংলাদেশে। জুনে সাধারণত ৪৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। কিন্তু এবারের জুনে হয়েছে ৩৭৫ মিলিমিটার। স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। আর এক মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে সংস্থাটি বলছে, জুলাইয়েও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হবে দেশে। যদিও গত দুদিনই প্রায় সারা দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে শনিবার সিলেটে ১৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। আর রোববার নেত্রকোনায় ১৮৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। শনিবার ঢাকায় ৮২ আর রোববার ১১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শনিবারের ৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে যে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় তা রোববারও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছিল।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ঢাকায় যে জলাবদ্ধতা সেটাকে নগরবন্যা বলা যায়। এর দায় যতটা না অল্পসময়ে অধিক বৃষ্টির, তার চেয়ে বেশি নগর ব্যবস্থাপনার। ড্রেন, স্যুয়ারেজ আর খালগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। নির্মাণ কাজের বিভিন্ন সামগ্রী ও পলিথিনসহ আবর্জনায় এসব ভরে গেছে। ফলে পানি আশপাশের নদ-নদীতে যেতে পারছে না। যে শহরের চারদিকেই নদী সেই শহরে এই জলাবদ্ধতা বা নগরবন্যা হওয়ার কথা নয়।
সম্প্রতি বুয়েটের ছয় গবেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের বন্যার ওপর একটি গবেষণা করেছেন। এতে নেতৃত্ব দেন বুয়েটের উল্লিখিত অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বিশ্বে তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এ কারণে বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ও বেড়ে গেছে। গঙ্গা অববাহিকায় বন্যার পরিমাণ ২৭ শতাংশ বাড়তে পারে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্রে ২৪ এবং মেঘনা অববাহিকায় ৩৮ শতাংশ বেশি হতে পারে বন্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বন্যার ক্ষেত্রেই নয়, অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও গত কয়েক বছর ধরে বেশি হচ্ছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে আছে, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র দাবদাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। গত কয়েক বছর ধরে প্রতিবারই ২-১টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটাও ছিল।