জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা।
বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য ইসির পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করেন তারা। এ সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে তফশিল ঘোষণার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এখন কমিশন সভা করে জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা সারবে। তফশিল ঘোষণা এবং পরবর্তী পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন নিয়ে চলছে তোড়জোড়। ব্যালট ছাপাতে কেপিএম থেকে কাগজ সংগ্রহ করছে ইসি।
তফশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে কমিশন। তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কমিশন সভা ডাকা হয়নি। আগামী সপ্তাহের মধ্যে কমিশন সভা হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভার দিনই তফশিল ঘোষণা হতে পারে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। যদিও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তারা ধর্মঘট-অবরোধের মতো কর্মসূচিও পালন করছে।
বিরোধী দলগুলোর অবরোধের মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে যান সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। সাক্ষাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সাংবিধানিক রীতিনীতি ও বিধিবিধান অনুসরণ করে কমিশনকে সাহসিকতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
অপরদিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে দ্রুত তফশিল ঘোষণার কথা জানান সিইসি। তিনি বলেন, যে কোনো মূল্যে নির্ধারিত সময়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। দ্রুত নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হবে। ২৯ জানুয়ারির আগেই নির্বাচন করতে হবে বলেও জানান তিনি। সিইসি বলেন, নির্ধারিত সময় ও পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের তফশিল নিয়ে এখনো পুরোপুরি সিদ্ধান্ত হয়নি। পরে কমিশনের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। যথাসময়ে নির্বাচন হবে।
পারিপার্শ্বিক ও সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আগামী নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের তফশিল এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নির্বাচন কমিশনাররা আনুষ্ঠানিক সভা করে তফশিল চূড়ান্ত করবেন। এরপর ওই তফশিল ঘোষণা করা হবে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের রেওয়াজ আছে। ওই রেওয়াজ অনুযায়ী এ সাক্ষাৎ করলেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এখন তফশিল ঘোষণার বিষয়টি পুরোপুরি ইসির এখতিয়ারাধীন। তারা আরও জানান, এবারও জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের মধ্য দিয়ে তফশিল ঘোষণা করা হবে। তফশিল ঘোষণা থেকে ভোট পর্যন্ত কমবেশি ৫০ দিনের ব্যবধান রাখা হতে পারে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ ও সম্ভাবনা কমে আসছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে আবারও একপাক্ষিক নির্বাচন হবে। তখন নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাও কঠিন হবে। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ অনেক দল অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে জ্বালাও-পোড়াও হয়েছিল। ওই সময়ে দেশে দীর্ঘমেয়াদি হরতাল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এবার নির্বাচনে বিএনপিসহ কয়েকটি দল অংশ নেবে না বলে আসছে। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সিইসির অবস্থান জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যান।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে ইসি। অন্যান্য নির্বাচনে তফশিল ঘোষণার পর এ ধরনের বৈঠক হয়ে থাকে। এবার আগাম প্রস্তুতি হিসাবে তফশিল ঘোষণার আগেই এ বৈঠক করেছে ইসি। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকেও প্রতিনিয়ত তথ্য সংগ্রহ করছে। এছাড়া তফশিল ঘোষণার পর আবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কৌশল নির্ধারণ করছে ইসি।
রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান রাষ্ট্রপতির : গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে কমিশনের প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎকালে আলোচনায় রাষ্ট্রপতি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন নির্বাহী বিভাগসহ জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ লক্ষ্যে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একসঙ্গে চলে। নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামতের প্রতিফলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন এবং প্রতিনিধির মাধ্যমেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়ে থাকে।
মো. সাহাবুদ্দিন আশা করেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা করবে। সাক্ষাৎকালে সিইসি জানান, সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশন ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাহী বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দ্রুত তফশিল ঘোষণা করব-সিইসি : রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৫২ মিনিটে বঙ্গভবনে যান সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। এক ঘণ্টা পর বেলা ১২টা ৫২ মিনিটে বেরিয়ে আসেন। সেখানে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন সিইসি। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতিকে আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করেছি। উনি শুনেছেন, সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি আশা ব্যক্ত করছেন যে আসন্ন নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে হবে। এ ব্যাপারে ওনার যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা তিনি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা বলেছি, আপনার সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন হলে আমরা তা গ্রহণ করব।
সংবিধান অনুযায়ী ইসি নির্বাচন করছে জানিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছি, সাংবিধানিকভাবে যে দায়িত্ব আমাদের ওপর আরোপিত হয়েছে এবং সেখানে যে বাধ্যবাধকতা আছে, আমরা সেই অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে এবং নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। আমরা ওনাকে বলেছি, আমরা সব রাজনৈতিক দল, সরকার ও জনগণের সহযোগিতা নিরবচ্ছিন্নভাবে কামনা করে যাচ্ছি।
সাক্ষাতে সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে ওনাকে জানিয়েছি যে, নির্বাচন অত্যাসন্ন। এটা উনিও জানেন যে, নির্বাচনের শেষ সময়টা ২৯ জানুয়ারি। এর আগেই ভোট করতে হবে। আমরা জানিয়েছি, এখনো সময়সূচির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো বলেছি যে, তফশিল দ্রুত ঘোষণা করব। কারণ, নির্বাচনের সময় হয়ে গেছে। নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা যেটি বলেছি প্রথম সপ্তাহে বা দ্বিতীয় সপ্তাহে, আমরা এখনো ওই অবস্থায় আছি। তবে আমরা বসে যখন এটি চূড়ান্ত করব, তখন আপনাদের অবহিত করব। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতে রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা হয়েছি কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, না। ওটা নিয়ে আমাদের তেমন আলোচনা হয়নি। আমরা শুধু আমাদের কথা বলছি এবং আমরা প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছি যে আমরা যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হয়, সে বিষয়ে সবাই যেন সহযোগিতা করেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, বেগম রাশেদা খানম, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান এবং ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম উপস্থিত ছিলেন।
দ্বিতীয় ধাপে ডিসি-এসপিদের প্রশিক্ষণ শুরু আজ : বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের দ্বিতীয় ধাপের প্রশিক্ষণ কর্মশালা আজ শুক্রবার শুরু হচ্ছে। দুই দিনের এ আবাসিক প্রশিক্ষণ শনিবার শেষ হবে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে। এবারের প্রশিক্ষণে ৩২ জেলার ডিসি ও এসপি ছাড়াও বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশ কমিশনারসহ ১১৪ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশ নেবেন। সকাল সাড়ে ৯টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান অতিথি হিসাবে এ কর্মশালার উদ্বোধন করবেন। এতে অন্য চার কমিশনার ও ইসি সচিব উপস্থিত থাকবেন।
এর আগে ২ ও ৩ নভেম্বর নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে দুই দিনের আবাসিক এ প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা ছিল। বিএনপির কর্মসূচির কারণে সেটি স্থগিত করা হয়। এর আগে পূজার কারণে আরেক দফা পেছানো হয়েছিল কর্মসূচিটি। ১৪ ও ১৫ অক্টোবর দেশের ৩২টি জেলার ডিসি, এসপি, চার বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ও মেট্রোপলিট্রন পুলিশ কমিশনারসহ ১১৬ জন নিয়ে প্রথম ধাপের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ হয়।
ব্যালট ছাপতে কেপিএম থেকে কাগজ সংগ্রহ করছে ইসি : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট ছাপাতে এশিয়ার বৃহত্তম কাগজের কল রাঙামাটির কর্ণফুলি পেপার মিল (কেপিএম) থেকে কাগজ সংগ্রহ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইতোমধ্যে ইসির চাহিদা অনুযায়ী কাগজ সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে কেপিএম ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হবে। এজন্য কেপিএম থেকে ১ হাজার ৬০০ টন কাগজ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েক ট্রাক কাগজ নির্বাচন কমিশনের প্রধান দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার আরও সাত ট্রাক কাগজ সরবরাহ করেছে কেপিএম। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম আনিসুজ্জামান জানান, আমরা নির্বাচন কমিশনকে যথাসময়ে কাগজ দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টায় রয়েছি। এছাড়া কাগজ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে।