বাজারে আগুন যেন থামছেই না। যৌক্তিক কারণ ছাড়াই যে যার মতো জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম এক সপ্তাহর ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে হতভম্ব, সংক্ষুব্ধ; কিন্তু অসহায় সবাই। কারও যেন কিছুই করার নেই। মাসের বাজেট দিয়ে সপ্তাহ পার করাই দুষ্কর। গরিবের কষ্টের বাজার শুধু কান্নায় ভরা। মধ্যবিত্তের হাসফাঁস অবস্থা। অনেকে বাধ্য হয়ে শুধু খাবারের বাজেট কাটছাঁট করছেন।
এদিকে সরকার অবস্থা সামাল দিতে সরকারি চাকরিজীবীদের মূল বেতন পাঁচ শতাংশ বাড়াচ্ছে জুলাই থেকে। কিন্তু সরকারের এই উদ্যোগ সমুদ্রের মধ্যে এক ফোঁটা শিশির বিন্দু পড়ার মতো অবস্থা।
কারণ, দেশের লোকসংখ্যা ১৮ কোটি ধরা হলে সরকারি চাকরিজীবীদের সংখ্যা সব মিলিয়ে ২০ লাখের বেশি হবে না। স্বভাবত প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বাদ পড়া বিশাল জনগোষ্ঠীর আয় বাড়াবে কে?
কিংবা সাধারণ মানুষের আয় বাড়ানোর জন্য সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে। অস্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতি নিয়ে যুগান্তরের কাছে এমন সব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ঈদের আগে ও পরে বাজারে আসা ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, ‘আমরা যারা সরকারি চাকরি করি না, আমাদের আয় বাড়াবে কে?’ বিশ্লেষকরা দুষছেন নিয়ন্ত্রণহীন বাজার সিন্ডিকেটকে।
প্রতিবেদক শনিবারও রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে লাগামহীন বাজার পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণহীন চিত্র দেখতে পান। জানতে চাইলে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান যুগান্তরকে বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপে সবাই পিষ্ট। সরকারি কর্মচারীদের প্রণোদনা দেওয়ায় তাদের একটু হলেও স্বস্তি হবে। কিন্তু বাকি জনগণের কী হবে? কারণ, বাজারে সবাই যায়। তাই সরকারের উচিত হবে, দেশের সব মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যবস্থা করা।
পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করা। টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বেশি করে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করা। এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে। কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে একশ্রেণির অসাধু সিন্ডিকেট চক্র। তাদের কারসাজিতে কিছু পণ্যের দাম সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
সরকারের যেসব সংস্থা জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে কাজ করছে, তারাও একরকম নিশ্চুপ। এছাড়া আগে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিন্ডিকেট নেই বলে দাবি করা হলেও তা মেনে নেওয়া হয়েছে।
আবার বাণিজ্যমন্ত্রী সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির দায় নিতে নারাজ। কিছু পণ্যের দায় অন্য মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে বলে বলছেন। ফলে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে সরকারের মধ্যে একধরনের সমন্বয়হীনতাও স্পষ্ট হচ্ছে।
এদিকে রোজার ঈদে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছিল, কুরবানির ঈদ ঘিরে সেসব পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাজারে এসব পণ্যের কোনো সংকট নেই। অথচ দাম বেশি।
এতে নিম্নবিত্ত ছাড়াও মধ্যবিত্তদেরও নাভিশ্বাস বেড়েছে। আর খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অনেকে এখন সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মাছ-মাংস পর্যন্ত কিনতে পারছেন না।
গরিবের জন্য বাজার করা এখন সবচেয়ে কষ্ট আর হতাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ বাজারে গিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকছেন। যারা ভেবেছিলেন কুরবানি ঈদের পর পণ্যের দাম কিছুটা কমবে, তাদের সেই আশাও পূরণ হয়নি। এ আশায় শনিবার যারা বাজারে গিয়েছেন, তাদের চরমভাবে হতাশ করেছেন বিক্রেতারা।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিযোগিতা নেই।
কিছু অসাধু বিক্রেতা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে নাজেহাল করে তুলছেন। দেখার জন্য যারা আছেন, তারাও রহস্যজনক কারণে নিশ্চুপ। সরকার সবকিছু বিবেচনা করে সরকারি কর্মজীবীদের ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) নিয়ম আছে। সব মিলে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ কর্মকর্তা। তারা নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম কিছুটা হলেও সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু অন্যদের জন্য কোনো সুখবর নেই। বাজারে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছে। ফলে এই অবস্থা থেকে তাদের বের করে আনতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
রাজধানীর নায়াবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার, কাওরান বাজারসহ একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শনিবার প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা, যা তিন মাস আগে ৪৫ টাকা ছিল। প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৭৫ টাকা, একই চাল তিন মাস আগে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
প্রতি কেজি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা, যা ১৫০ টাকা ছিল। আদার কেজি সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা, তিন মাস আগেও ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকা, যা আগে ১২০-১২৫ টাকা ছিল। প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৯৫০-১০০০ টাকা, যা তিন মাস আগে ৪৫০ টাকা ছিল।
সস্তা দামের পাঙাশ মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা, যা আগে ১৮০-২২০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা, যা তিন মাস আগেও ৬৫০ টাকা ছিল। সবজির মধ্যে প্রতি কেজি বেগুন ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ৮০ টাকা। বলতে গেলে বেশির ভাগ সবজির দাম ১০০ টাকার মধ্যে।
রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. জাফর ইকবাল (৫২) যুগান্তরকে বলেন, বাসায় আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। সঙ্গে স্ত্রী ও মাসহ আমরা পরিবারে মোট পাঁচজন। ভ্যান চালিয়ে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা ইনকাম করি।
আবার কোনোদিন আয় হয় না। এই আয় দিয়ে পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। কারণ, বাজারে সব ধরনের পণ্যের অনেক দাম। কী রেখে কী কিনব, সেটা ভেবে পাচ্ছি না। চাল কিনলে ডালের টাকা থাকছে না।
তেল কিনলে সবজির টাকা থাকছে না। এর মধ্যে বাসা ভাড়া ও পরিবারের অন্যান্য খরচ বহন করতে ঋণ করে চলতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ঈদে সবাই কিছু না কিছু ভালো খাবার জোগাড় করে। কিন্তু আমার এই আয় দিয়ে ঈদের আগে বাজারে আসতে পারিনি। ভেবেছিলাম ঈদের পর পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু এসে দেখি আরও বেড়েছে।
মালিবাগ কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে এসেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. ওয়ালিউল্লাহ (৪৭)। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পাই। তা দিয়ে পরিবারের ছয় সদস্যের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
খেয়ে বেঁচে থাকতে অল্প পরিমাণে পণ্য কিনতে হচ্ছে। আর অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে। তারা স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটালেও আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারা যে টাকা ইনকাম করে, তা দিয়ে ভালোভাবে চলতে পারছে। কিন্তু আমাদের কী হবে।’
নয়াবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. তুহিন বলেন, ‘কিছু সিন্ডিকেটের হাতে পুরো দেশ জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে ধনীদের কোনো সমস্যা না হলেও গরিব মানুষ খুব কষ্টে আছে।
কারণ, আমি বিক্রেতা, আমি দেখি, যিনি আগে এক কেজি পণ্য কিনতেন, তিনি এখন আধা কেজি কিনছেন। আর ধনীরা পণ্যের লিস্ট দিয়ে বাজার করছেন। কত টাকা হচ্ছে, তার খবর রাখছে না। কেনা শেষ হলে কেউ কেউ ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছেন। যখন বলছি, আমার দোকানে ক্রেডিট কার্ড চলে না, সেক্ষেত্রে গালমন্দ করছেন। কারণ, তাদের টাকার হিসাব নেই। তাই মধ্য ও নিম্নবিত্তদের বাঁচাতে বাজারে শৃঙ্খলা আনতে হবে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।’
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালক শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে, তা বলা যাবে না। তবে এটা ঠিক, কিছু ব্যবসায়ীগোষ্ঠী পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেক সময় অভিযান পরিচালনা করেও তাদের কিছু করা যাচ্ছে না। তারা যে পণ্যের দাম বাড়াতে চাচ্ছে, তা তারা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছি না।
প্রসঙ্গত, নিয়ন্ত্রণহীন বাজার সিন্ডিকেট। কার্যত সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা একরকম অসহায়। মুদ্রাস্ফীতিসহ বাজারে সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়টি নিয়ে ঈদের আগে জাতীয় সংসদ সরগরম হয়। বিষয়টি নিয়ে ঈদের আগে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। কিন্তু সবকিছু যেন আলোচনা ও প্রতিবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে আমদানিকারক সিন্ডিকেটসহ সব পর্যায়ের বিক্রেতার হাতে।