লোকসানের লাগাম টানতে লোকাল, মেইল, কমিউটারসহ ৯২টি ট্রেন এবং ১১১টি স্টেশন পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে স্থানীয় যাত্রীদের একটি বড় অংশ দূরের স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ভ্রমণ করছেন।
দীর্ঘদিন এসব ট্রেন ও স্টেশন বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। বন্ধগুলো চালুর উদ্যোগ না থাকলেও নতুন স্টেশন নির্মাণ, ট্রেন উদ্বোধন অব্যাহত আছে।
জানা যায়, বন্ধ স্টেশনগুলো রেলের খাতায় ‘অলাভজনক’ হিসাবে চিহ্নিত। এসবের অধিকাংশই ‘সি’ ক্যাটাগরির। এগুলোর মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ও ট্রেন বন্ধ রেখে আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এক যুগে প্রায় ১৫০টি আন্তঃনগর ট্রেন উদ্বোধন করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ১০৪টি নতুন স্টেশন। বন্ধ ট্রেনের কিছু কোচ এবং আন্তঃনগর ট্রেনের বাতিল-পুরোনো কোচ দিয়েই বেশির ভাগ নতুন ট্রেন উদ্বোধন করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপারেশন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বন্ধ স্টেশনগুলো আধুনিক রেলের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। অত্যাধুনিক ইঞ্জিন-কোচ দিয়েও বন্ধ স্টেশনগুলোর এলাকায় গতি উঠানো যাচ্ছে না। নির্দেশনা অনুযায়ী বন্ধ স্টেশন এলাকায় গতি কমিয়ে ট্রেন চালানো বাধ্যতামূলক।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আন্তঃনগর ট্রেনের চেয়ে লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনে তেল কম খরচ হয়। আন্তঃনগরে ব্যয় বেশি। সাধারণ ট্রেনকে কম গুরুত্ব দিয়ে আন্তঃনগর ট্রেনকে অগ্রাধিকার দিলেও লোকসান প্রতিবছরই বাড়ছে। খোদ আন্তঃনগর ট্রেনেই টিকিটধারীর চেয়ে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করছে তিনগুণেরও বেশি। বন্ধ স্টেশন ও ট্রেন চালুর দাবিতে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন হচ্ছে, কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তা আমলে নিচ্ছে না।
রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, বন্ধ স্টেশনগুলোর অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলের। রেলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কম দূরত্বের মধ্যে যেসব স্টেশন রয়েছে, তা বন্ধ রেখেই ট্রেন চালাতে হবে। তবে যেসব স্টেশন ও ট্রেন গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্টেশন মাস্টার, ট্রেনচালক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ৬০০ স্টেশন মাস্টার নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে। তারা যোগ দিয়ে বন্ধ স্টেশনগুলোর অনেকই দ্রুততার সঙ্গে চালু করা হবে।
ট্রেন সাধারণ মানুষের বাহন স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন করছে। চলমান প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। স্থায়ীয় ট্রেনযাত্রী এবং রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বন্ধ স্টেশনগুলোর অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলের। স্বাধীনতার আগে ও পরে এসব স্টেশন হয়ে বন্ধ ট্রেনগুলো চলাচল করত। পূর্বাঞ্চল রেলে ১৯৭২ সাল থেকেই ঈশা খাঁ, জালালাবাদ নামে দুটি ট্রেন চলাচল করত। গত কয়েক বছরে এ দুটি ট্রেনসহ ৫৪টি ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পশ্চিমাঞ্চল রেলে বন্ধ রয়েছে ৩৮টি ট্রেন।
এসব ট্রেন গণপরিবহণ হিসাবে পরিচিত ছিল। এগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ বেকায়দায় পড়েছে। কারণ, বন্ধ ট্রেনগুলোয়ই সাধারণ যাত্রীরা বেশি চলাচল করতেন। এসব ট্রেন সব স্টেশনে দাঁড়াত বলে স্থানীয় যাত্রীরা কম দূরত্বেও ট্রেনে চলাচল করত। নিম্ন-আয়ের লোকজন, অফিসগামী মানুষের ভরসা ছিল দুই অঞ্চলে বন্ধ থাকা ৯২টি ট্রেন। সারা দেশে ৪৬৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। ২ বছর আগে বন্ধ ট্রেনের সংখ্যা ছিল ১২৭টি। বর্তমানে ৯২টি।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে ৫০৭ কিলোমিটার নতুন রেলপথ, ১০৪টি নতুন রেলওয়ে স্টেশন ভবন, ৪৮৪টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করেছে। এছাড়া ৫২০টি অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী কোচ, ৭৪টি লোকোমোটিভ, ২০ সেট ডেমু, ৫১৬টি ওয়াগন, ৩০টি ব্রেক ভ্যান এবং ২টি শক্তিশালী রিলিফ ক্রেন ক্রয় করেছে। দপ্তরসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রেলে সরকারের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে বন্ধ স্টেশন-ট্রেন চালু করা হচ্ছে না। অথচ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে জরাজীর্ণ রেলপথ, সেতু শতভাগ সংস্কার করে রেলপথকে নিরাপদ করার। বন্ধ স্টেশন চালু করার। এমন নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে বছর বছর।
আন্তঃনগর ট্রেন চালান এমন বেশ কয়েকজন ট্রেনচালকের ভাষ্য, বন্ধ স্টেশন এলাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায় পড়ে তাদের কাঁধে। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সিগন্যাল হওয়ায় তারা নামমাত্র গতি নিয়ে স্টেশন এলাকা অতিক্রম করেন।
এদিকে রেলওয়ে মেকানিক্যাল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, লোকবলের অভাবে বন্ধ স্টেশনগুলো চালু করা যেমন সম্ভব হচ্ছে না, তেমনই ইঞ্জিনের অভাব বন্ধ ট্রেনগুলো চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে যেসব ইঞ্জিন রেলবহরে রয়েছে, এর প্রায় ৭৪ শতাংশেরই মেয়াদ পার হয়ে গেছে। একটি ইঞ্জিনের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর। ৭৪ শতাংশ ইঞ্জিনের বয়স ৪০ থেকে ৫৪ বছরের বেশি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, বন্ধ ট্রেন, স্টেশন চালুর সঙ্গে সম্পৃক্ত যারা, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। বন্ধ স্টেশন ও ট্রেন চালু করা জরুরি। এসব স্টেশন হয়েই সাধারণ মানুষ চলাচল করত। রেল সাধারণ মানুষের বাহন। তিনি বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্টদের সেদিকে খেয়াল নেই।