খুরশিদ আলম সেলিম শিল্পকে ইতিহাসের সূত্র মনে করেন। সৌন্দর্য সৃষ্টির অভিপ্রায়ে নিজে আঁকেন প্রধানত বিমূর্ত ধারার ছবি। বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত আমেরিকান এই শিল্পী বেইজিং অলিম্পিকে আমেরিকার হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। ২০১৩ সালে ইউনেসকো অ্যাওয়ার্ডসহ পেয়েছেন অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। চারুকলার সাবেক এই ছাত্র ৩৬ বছর ধরে আমেরিকায় শিল্পীজীবন কাটাচ্ছেন। সম্প্রতি ধানমণ্ডির গ্যালারি চিত্রতে হয়ে গেল তাঁর ৮০তম একক চিত্র প্রদর্শনী। খুরশিদ আলম সেলিম এ প্রতিনিধিকে বলেন,প্রকৃতিতে আমরা যা কিছু দেখি সবই ফর্ম আর রঙের বিন্যাস
শিল্পী খুরশিদ আলম সেলিমের সাথে কথোপকথন তুলে ধরা হলো ।
প্রশ্ন : আপনার সর্বশেষ প্রদর্শনী ‘লুকায়িত সৌন্দর্য’ সম্পর্কে বিস্তারিত শুনতে চাই।
খুরশিদ আলম সেলিম : বাংলাদেশ ছাড়াও আমেরিকা, জাপান, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, মরক্কো, চীন, ভারত, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইরান, গ্রিস, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, উজবেকিস্তান ও রাশিয়ায় আমি একক প্রদর্শনী করেছি। সম্প্রতি ধানমণ্ডির গ্যালারি চিত্রকে আমার ৮০তম একক চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেছে। এই প্রদর্শনীর নাম দিয়েছি ‘লুকায়িত সৌন্দর্য’। আমি মূলত বিমূর্ত ছবি আঁকি। বিমূর্ত শিল্পে অনেকের নির্ধারিত বিষয় থাকে, অনেকের থাকে না। এটি মূলত ফর্ম ও রঙের বিন্যাস। অনেকটা প্রকৃতির মতো। একটি গোলাপ ফুল রঙের বিন্যাস ছাড়া আর কিছু না। মানুষ এটিকে নাম দিয়েছে এবং দেখছে। ফলে এটি ‘রিয়েলিস্টিক’ হয়ে গেছে। প্রকৃতিতে আমরা যা কিছু দেখি সবই রং ও ফর্মের বিন্যাস। বিভিন্ন শিল্পী বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ছবি আঁকেন। হতে পারে সেটি প্রকৃতি, ধর্ম, সমাজ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আমার যে ছবি তারও একটি উদ্দেশ্য আছে। ময়ূরের গায়ে প্রকৃতি একটি রঙের বিন্যাস করেছে। একটি সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা এর দিকে তাকাই। আমিও ক্যানভাসে আমার মতো করে একটি সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছি। আমি যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছি, তা আগে কেউ দেখেনি। সৌন্দর্যটি লুকায়িত ছিল, আমি সেটি প্রকাশ করেছি। এ জন্যই আমার প্রদর্শনীর নাম ‘হিডেন বিউটি’ বা লুকায়িত সৌন্দর্য।
প্রশ্ন : ৮০টি একক প্রদর্শনী একজন চিত্রশিল্পীর জীবনকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে?
খুরশিদ আলম আলম সেলিম : আমি যদি দেখি কোনো শিল্পী শুধু এককভাবে ৮০টি প্রদর্শনী করেছেন, তাহলে বুঝব শিল্পী খুবই সক্রিয়। তিনি অত্যন্ত কর্মময় একজন শিল্পী। একক প্রদর্শনী ছাড়াও আমি বহু দেশে দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছি। অলিম্পিক আমাকে গোল্ড মেডেল দিয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছি।
প্রশ্ন : দিন দিন শিল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, না কমছে? আপনি কী মনে করেন?
খুরশিদ আলম সেলিম : নিঃসন্দেহে বাড়ছে। শিল্পের দুটি দিক আছে। একটি হলো ব্যাবহারিক বা কমার্শিয়াল দিক; আরেকটিকে সুকুমার শিল্প বলা যেতে পারে। দুনিয়াজুড়ে প্রতিদিন পণ্যের প্রসার ঘটছে। প্রতিটি পণ্যের একটি মোড়ক আছে। সেখানে একটি ডিজাইন আছে। বিজ্ঞাপন চলছেই। বিজ্ঞাপন না দেখে কেউ কিছু কিনছে না। মানুষ একটি বাড়ি বানাবে, তার জন্য আগে ডিজাইন দেখছে। ফলে মানুষ শিল্পের ভেতরেই আছে। শিল্প এখানে জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে সারা বিশ্বের শিল্পীরা জড়িয়ে আছেন।
প্রশ্ন : আপনার শিল্পজীবনকে আলোকিত করেছে বা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে কোন ঘটনা?
খুরশিদ আলম সেলিম : আমি ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলাম। ৩৬ বছর আগে শিল্পকলার ডেপুটি ডিরেক্টরও ছিলাম। বাংলাদেশের যে শিল্প আন্দোলন, তা আমাদের হাত দিয়েই হয়েছে। আমরাই তখন ছিলাম। এই ঢাকায়ই শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া দ্বারা আমি প্রভাবিত হই। এখানেই বিমূর্ত শিল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। এটি একটি ওয়েস্টার্ন ধারা। বাংলাদেশের অনেক শিল্পীই বিমূর্ত ধারার শিল্পী ছিলেন; যেমন—মোহাম্মদ কিবরিয়া, রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী ও আমিনুল ইসলাম। ষাটের দশকেই অনেক শিল্পীর মাধ্যমে এখানে বিমূর্ত ধারার শিল্পকর্ম পরিচিতি পেতে থাকে। এর কারণ হলো ১৯৪৮ সালের দিকে অনেক শিল্পী ইউরোপে গিয়ে পড়াশোনা করে ফিরে আসেন। স্থানীয় শিল্পীরা আধুনিক লোকধারার শিল্প নির্মাণ করছিলেন তখন। ইউরোপ থেকে ফেরত আসা শিল্পীদের হাত ধরেই বিমূর্ত ধারার শিল্পচর্চা শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশে এটি খুব নতুন ধারা নয়। তবে আমি যে ফর্মে কাজ করছি, সেটি একটু ভিন্ন।
প্রশ্ন : বিমূর্ত শিল্প নির্মাণে আপনি কেন আগ্রহী হলেন? এ ক্ষেত্রে শিল্প সৃষ্টিতে আপনার কৌশলটি কী?
খুরশিদ আলম সেলিম : ১৯৮২ সালে চারুকলায় প্রথম একক প্রদর্শনী করেছিলাম। সেই প্রদর্শনীর নাম ছিল ‘লোকালয়’। আমার আঁকা বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন রোমান্টিক ছবি সেখানে প্রদর্শিত হয়। তারপর অনেক ধরনের কাজই করেছি। কিন্তু এর ভেতর কিবরিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ি। তা ছাড়া দেখলাম এখানে শিল্পীর অনেক স্বাধীনতা আছে এবং একটা গবেষণার বিষয়ও আছে। এই মাধ্যমে ক্রিয়েটিভিটিটা অনেক বেশি। যেকোনো বাস্তব ছবি সামনে মডেল রেখে আপনি দেখে দেখে আঁকবেন। গাছ আঁকলে গাছ দেখছেন, নদী আঁকলে নদী, মানুষ আঁকলে মানুষ। যা-ই আঁকেন ব্রেনের মধ্যে একটা মডেল আছে। কিন্তু বিমূর্ত চিত্রধারায় কোনো মডেল নেই।
প্রশ্ন : আপনার জন্ম বাংলাদেশে, দীর্ঘদিন ধরে থাকছেন নিউ ইয়র্কে। দুই দেশের প্রকৃতি ও মানুষ আপনার শিল্পে কিভাবে আসে?
খুরশিদ আলম সেলিম : ৩৬ বছর ধরে আমি আমেরিকায় থাকছি। এটি এমন এক দেশ যে এখানে মরুভূমি আছে, পাহাড় আছে, সাগর আছে, সমতল ভূমি আছে। নাই বলে এমন কিছু আসলে এ দেশে নেই। এটি দেশ হলেও একটি মহাদেশের মতো। আবার আমাদের দেশটি আমেরিকার ফ্লোরিডার মতো। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রকম মানুষ। দুই দেশের জীবনযাপনে পার্থক্য তো রয়েছেই।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে বহির্বিশ্বের শিল্পীরা কেমন ধারণা রাখেন?
খুরশিদ আলম সেলিম : আমি আমেরিকায় সাত বছর একটি গ্যালারি চালিয়েছি। মহামারির কারণে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে যদিও। তখন বাংলাদেশের অনেকের প্রদর্শনী হয়েছে সেখানে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে প্রদর্শনী করেছি। আমেরিকার নারী শিল্পীদের সঙ্গে বাংলাদেশের নারী শিল্পীদের নিয়ে দলীয় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছি। ভারতসহ অন্য অনেক দেশের যে কমিউনিটি আমেরিকায় রয়েছে, তাদের শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনেকটা আগ্রহ রয়েছে। আমাদের যাঁরা চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক বা এমন পেশার প্রবাসী আমেরিকায় রয়েছেন, তাঁদের মাঝে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ আমি দেখিনি। চিত্রশিল্পের প্রতি তাঁদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। এমনকি ঢাকায় যে আগ্রহ আছে, সেটুকুও এখানকার প্রবাসীদের নেই।